শত শত মুখ হায় একাত্তর/যশোর রোড যে কত কথা বলে/এত মরা মুখ আধমরা পায়ে/পূর্ব বাংলা কলকাতা চলে/সময় চলেছে রাজপথ ধরে/যশোর রোডে মানুষ মিছিল…’, কথাগুলো শুনলে গায়ে শিহরণ বয়ে যায়। অ্যালন গিনসবার্গের বিখ্যাত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার এ বাক্যগুলো গানেও রূপ পেয়েছে। ঐতিহ্যবাহী যশোর রোডের দুপাশে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে শত শত গাছ। কালের সাক্ষী এসব গাছ আজ হুমকির মুখে পড়েছে।
উন্নয়নের কাছে ‘বলি’ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে মুক্তিযদ্ধের সাক্ষী দুই সহস্রাধিক গাছ। তবে পরিকল্পনাবিদদের দাবি, গাছ না কেটেও যশোর রোডের সম্প্রসারণ সম্ভব। গাছ রেখেই এই মহাসড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা যায়। তবে সঠিক পরিবল্পনার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হবে।
এমনই একটি পরিকল্পনা বাতলে দিলেন নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী ইকবাল হাবিব। প্রিয়.কমকে তিনি বলেন, যশোর রোডের দুইপাশে রয়েছে অনেক গাছ। সড়কের একপাশের গাছকে সড়ক বিভাজক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। অন্য পাশ দিয়ে তৈরি করতে হবে আলাদা একটি সড়ক। যা হবে সড়কটির আলাদা একটি লেন। যদিও এক্ষেত্রে সড়ক বিভাজকের প্রস্থ হবে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়। এতে গাছও কাটা পড়বে না। আবার সড়কও প্রশস্ত হবে। অনেক উন্নতে দেশে এভাবে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।
ইকবাল হাবিব বলেন, ‘উন্নয়ন দরকার। তবে তা পরিবেশ বাদ দিয়ে নয়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন ও পরিবেশের ক্ষতি না হওয়ার সমন্বয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে আরও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। নইলে আস্তে আস্তে উন্নয়নের কাছে পরিবেশের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটবে।’
যশোর রোডের গাছ কাটার বিষয়টি নিশ্চিত করে যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ দ্রুত শুরু হবে। আর এ কারণে গাছ কাটতে হবে। গাছ থাকলে রাস্তা বানানো হবে কীভাবে? সবাই মিলেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন করতে গেলে গাছ কাটা পড়বে এটাই তো স্বাভাবিক।’
রাস্তার পাশে থাকা গাছগুলোকে বিভাজক হিসেবে ব্যবহার করে পাশ দিয়ে আলাদা একটি লেন তৈরি সম্ভব না জানিয়ে জাহাঙ্গীর আলম জানান, এতে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে। যান চলাচলের সময় গাছের সাথে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।
২০১৭ সালের মার্চে একনেকে পাশ হয় যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ক পুনঃর্নিমাণ প্রকল্প। এর ব্যয় ধরা হয় ৩শ’ ২৮ কোটি টাকা। ৩৮.২০ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে প্রশস্ত করা হবে ৩ মিটার। মূলত একারণেই কাটতে হবে রেইট্রিসহ বিভিন্ন প্রজাতির ২৩১২টি গাছ। এর মধ্যে রয়েছে অনেক শতবর্ষী বৃক্ষ। এমন সিদ্ধান্তের পর প্রতিবাদে সরব হন পরিবেশবাদীসহ নানা পেশার মানুষ। প্রবল সমালোচনার মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কর্তৃপক্ষ। জানানো হয় গাছ না কেটেই করা হবে সড়ক পুনঃর্নিমাণ।
কিন্ত গত ৬ জানুয়ারি যশোর জেলা প্রশাসন সম্মেলন কেন্দ্রে মতবিনিময় সভায় পরিবর্তন করা হয় গাছ না কাটার সিদ্ধান্ত। জানানো হয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য কাটতে হবে গাছ। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন যশোর ৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। যশোর রোডের গাছ কাটার বিষয়ে প্রিয়.কমকে তিনি বলেন, ‘সবার সস্মতিতেই গাছ কাটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুধু আবেগ দিয়ে তো আর উন্নয়ন হবে না। এটি এশিয়ান হাইওয়ের একটি অংশ হবে। এ সড়ক হবে দেশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক।’
গাছগুলোকে সড়ক বিভাজক হিসেবে ব্যবহার করে নতুন লেন করা প্রসঙ্গে যশোরের এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘এটি অবাস্তব পরিকল্পনা। উন্নত দেশের সড়ক নির্মাণে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। এত বড় গাছ রাস্তার ভেতর থাকলে বর্ষার সময় এর পাতা ও পানি পড়ে রাস্তায় দুর্ঘটনা যেমন বাড়বে, ঠিক তেমনি রাস্তার আয়ুও কমে যাবে।’
মুক্তিযুদ্ধের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত যশোর রোড এবং এর দুইপাশের অসংখ্য গাছ। এ সড়ক ধরেই ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন লাখো বাঙালি শরণার্থী ও প্রশিক্ষণ প্রত্যাশী মুক্তিযোদ্ধা। সড়ক দিয়ে হাঁটার সময় এই গাছগুলোর নিচেই বিশ্রাম নিতেন তারা। সেইসঙ্গে সড়কের দুইপাশে বড় আকৃতির গাছগুলোর সৌন্দর্যও চোখে পড়ার মতো। এসব কারণেই মূলত যশোর রোডের এই গাছগুলো নিয়ে এত আলোচনা।
খারাপ সংবাদ আছে ভারত অংশেও। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যশোর রোডের বড় অংশটি ভারতে। বারাশাদ থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এই সড়কের দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সরকার সড়ক সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়ার পর ভারত সরকারও উদ্যোগ নিয়েছে তাদের অংশের সড়ক সম্প্রসারণের। আর এতে কাটা পড়বে সাড়ে চার সহস্রাধিক গাছ। এ কারণে প্রতিবাদ চলছে ভারতেও।
জমিদার কালী পোদ্দারের বাস ছিল যশোরের কালীগঞ্জের নলডাঙ্গায়। কথিত আছে, জমিদার পুত্রের কাছে একবার গঙ্গা স্নানের ইচ্ছা পোষণ করেন তার মা। কিন্তু যশোর থেকে গঙ্গায় যাবার তখন কোনো সড়ক ছিল না। তাই জমিদার কালী পোদ্দার সিদ্ধান্ত নেন সড়ক নির্মাণের। অবশেষে যশোর থেকে গঙ্গার তীর পর্যন্ত দুই বছর ধরে তৈরি করা হয় সড়ক। নাম দেওয়া হয় যশোর রোড। এর দুপাশে অসংখ্য গাছও রোপন করেছিলেন কালী পোদ্দার। পরবর্তীতে যশোর রোডের বাংলাদেশ অংশের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় যশোর-বেনাপোল সড়ক। কিন্তু ভারতীয় অংশের নাম অপরিবর্তিত থাকে।
পাঠকের মতামত