নতুন বছরে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে দেশের মানুষের সামনে। আর ক্ষমতাসীন দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো— জনগণকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা, দলকে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আনা, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখা। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন বছরে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা ও চলমান অর্থনীতির সব সূচকের গতি ঠিক রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। একইসঙ্গে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ঠিক রাখতে বিশ্বে নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করার কথাও বলছেন তারা। এদিকে, মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে নিখোঁজ হওয়ার যে ভীতি, সেটি দূর করাটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ বিষয়ে নারী অধিকারকর্মীরা আশাবাদী হতে পারছেন না। তাদের মতে, চ্যালেঞ্জটা হলো নারীর ক্ষমতায়নকে অব্যাহত রাখা, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করা। কারণ ২০১৭ সালে সহিংসতার মাত্রা ও বীভৎসতা বাড়তে দেখা গেছে। এছাড়া দেশকে জঙ্গিমুক্ত রাখা ও সরকারের মেয়াদের শেষ বছরের বাজেটও সমান গুরুত্বের দাবি রাখে।
এদিকে, রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তাদের মতে, অস্থির বিচার বিভাগের অমীমাংসিত বিষয় ২০১৭ সালের শেষ ভাগে মীমাংসা হতে শুরু করলেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বড় ধরনের দায়িত্ব বাকি রয়ে গেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটিও দেখার বিষয়।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
২০১৭ সালে জিডিপিতে রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় এই প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ১৭ ভাগ বেশি। ফলে জিডিপির আকার বেড়ে হয়েছে ২৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের মানুষের এখন মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে বছরে ১,৬১০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টাকা। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের জায়গা চিহ্নিত করতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রফতানি প্রবৃদ্ধির হার যেটা আছে, সেটা গত অর্থবছরের মতোই থাকবে বলে মনে হচ্ছে। সেটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, রফতানি প্রবৃদ্ধি কম, কিন্তু আমদানি প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। কারেন্ট অ্যাকাউন্টের মাত্রা বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের কেলেঙ্কারি, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ— এসব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো সুশাসনের পরিপন্থী কিছু ব্যবস্থাও নিচ্ছে।’
রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো নতুন বছরকে ঘিরে তাদের প্রস্তুতি শুরু করেছে। নির্বাচনি রাজনীতির জন্য ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে এরই মধ্যে নিজেদের কৌশলও ঠিক করে ফেলেছে তারা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয়বার জয়ই হবে নতুন বছরে আওয়ামী লীগের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রথম ধাপ শুরু হবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনের মাধ্যমে। বছরের শুরুতেই এই সিটিতে জয়ের মাধ্যমে শুভ সূচনা করে আরও পাঁচ সিটিতে বিজয়ী হতে চায় দলটি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নতুন বছরে আমাদের প্রধান করণীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। দলকে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করার কাজ করতে হবে।’
রাজনৈতিক মাঠে আলোচিত আরেকটি বিষয় হলো খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলাগুলো। মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের শেষ পর্যায়ে এসে প্রশ্ন উঠছে— খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হলে বিএনপির নতুন নেতৃত্ব কী হবে।
এদিকে, বছরজুড়ে সরগরম ছিল আইন-আদালত পাড়া। একদিকে ছিল ৫৭ ধারা দিয়ে বাকস্বাধীনতা রোধের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অন্যদিকে ছিল বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট নিয়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্ব। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগ করে বিদেশ চলে যাওয়ার পর শৃঙ্খলাবিধির গেজেট নিয়ে জট খুলতে শুরু করে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, যে অভিযোগের পাহাড় নিয়ে সিনহা বিদেশ চলে গেছেন, সেগুলোর কী হবে।
আগামী বছর নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া, ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানি থেকে শুরু করে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের সমাধান করতে হবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৭ খুবই বিক্ষুব্ধ গেছে। বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির ভূমিকা, গণমাধ্যমে বিচার বিভাগ নিয়ে রিপোর্ট হওয়া— সব মিলিয়ে উত্থাপিত বিষয়গুলো একে একে সমাধান করা নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ।’
সামাজিক চ্যালেঞ্জ
২০১৭ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক। এ বছর ৯১ জন মানুষ গুম ও নিখোঁজ হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময় ও পুলিশি হেফাজতে নিহতের সংখ্যা মোট ১৬২ জন। এর মধ্যে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও গুলিবিনিময়ে নিহতের সংখ্যা ১২৬। আবার, সাংবাদিক-লেখকসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সহিংস ঘটনার শিকার হয়েছেন ২৫৫ জন। এ বছর সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮১ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন বড় শঙ্কার হয়ে দাড়িয়েছে কে, কোন কারণে নিখোঁজ হচ্ছে তার কোনও ব্যাখ্যা না পাওয়া। সাধারণ মানুষ যেমন— শিক্ষক কিংবা বিদেশে অধ্যয়নরত দেশি শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, এমনকি প্রকাশকের মতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও হারিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের কাছে মনে হয়, এটা অনেক বেশি ভয়াবহ, অনেক বেশি আশঙ্কার কারণ।’
নারীর প্রতি ঘরে-বাইরে সহিংসতার ধরণ ও মাত্রা দুই-ই বেড়েছে। নতুন বছরে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিবেদন বলছে, নথিভুক্ত হওয়া নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে ৭৭ শতাংশই ঘটেছে পারিবারিক পরিসরে। এর মধ্যে আবার যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের ঘটনাই ৩২ শতাংশ। আর পারিবারিক সংঘাতের ঘটনা ছিল ২৪ শতাংশ।
নারী প্রগতির নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সম্পর্কের ধরণ বদলাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। ফলে পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের প্রবণতাও কমছে না।’
এছাড়া, গত বছরের পুরোটাতেই আলোচনায় ছিল প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্ক। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে নিয়োগ পরীক্ষাতেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কোচিং বাণিজ্য নিয়ে ঘটনা গড়িয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন পর্যন্ত। শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ঘুষ বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি। শিক্ষাকে রাষ্ট্রের মগজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেই মগজে পচন ধরলে আপনার-আমার শরীর বাঁচিয়ে কোনও লাভ নেই।’
পাঠকের মতামত