নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনার নির্মম স্মৃতির সাক্ষ্য বয়ে চলেছেন বছরের পর বছর। ১৯৮৯ সালে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় তার জীবন।
কিন্তু ১৯৯৩ সালে সড়ক কেড়ে নেয় তার স্ত্রীর জীবন। প্রিয় হারানোর শোক শক্তিতে পরিণত করেন বাংলা চলচ্চিত্রের এই জনপ্রিয় নায়ক।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ স্লোগান নিয়ে ছুটে বেড়ান দেশের একপ্রাপ্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। এরপরই বাংলাদেশের সড়কে ফোরলেন, সড়কে ডিভাইডার তৈরি, মহাসড়ক থেকে নসিমন-করিমন উঠিয়ে নেওয়া, প্রতিবছর নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা- এমন অসংখ্য সাফল্য এসেছে।
ঠিক তেমনি সড়ক পরিবহণ শ্রমিকদের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে এই ‘নিঃস্ব শেরপা’কে। কিন্তু সময়ে-অসময়ে কখনোই নিজেকে রাজপথে থেকে উঠিয়ে নেয়নি।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে চেষ্টা করেছেন একটি যুগোপযোগী ও সবার স্বার্থরক্ষাকারী আধুনিক আইন প্রণয়নের জন্য জনমত গড়ে তুলতে। আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে টানা আন্দোলনের পর কাক্ষিত সেই পরিবহণ আইন এখন সড়কে।
যদিও নতুন এই সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে গত কয়েকদিন বাংলাদেশের বাস-ট্রাক শ্রমিকরা ‘কর্মবিরতি’ পালন করেছেন।
আর সেখানে চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিযোগ উঠেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবি সম্বলিত ব্যানার টাঙিয়ে কিংবা কুশপুত্তলিকা তৈরি করে সেখানে জুতার মালা দেয়া হয়েছে।
শ্রমিকদের এসব কর্মকাণ্ডে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কখনো-কখনো খারাপ লাগে। এতোটাই খারাপ লাগে যে যাদের জন্য আমি এতো কিছু জলাঞ্জলি দিয়েছি কোন কিছু পাওয়ার আশায় নয়।
আমি আমার সিনেমার ক্যারিয়ার শেষ করেছি নিরাপদ সড়কের জন্য। আমার সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেছি”।
এসব ছবির মাধ্যমে ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে বাস-ট্রাক শ্রমিকদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতি শ্রমিকদের এতো ক্ষোভের কারণ কী?
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য যে আন্দোলন সেটি তার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। তার প্রতি শ্রমিকদের ক্ষিপ্ত হবার এটিই কারণ বলে মনে করেন তিনি।
শ্রমিকরা মনে করে, সড়ক দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই। এটা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। আমি কেন বিষয়টা নিয়ে বলবো? তারা এটাই মনে করে।
ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার পেছনে মালিক-শ্রমিক নেতাদের উস্কানি রয়েছে। তিনি বলেন, এই শ্রমিকরা নেতাদের কথা দ্বারা প্রভাবিত।
নেতারা যা বলে শ্রমিকরা তাই শোনে। তাদেরকে বলা হয়, সড়কে যা কিছু হোক না কেন আমরা আছি। সেটা ন্যায় হোক, অন্যায় হোক,যা কিছু হোক।
“এটা শ্রমিকরা ঠিক এককভাবে করে নাই। শ্রমিক-মালিক সংগঠনের নেতৃত্ব যারা দিচ্ছে তারাই এ বিষয়টা করেছে”
ইলিয়াস কাঞ্চন প্রশ্ন তোলেন, “এই মালিক সমিতির নামে শ্রমিক সমিতির নামে যে কোটি-কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে, সে চাঁদা কোন উন্নয়নের কাজে লাগে?” তিনি অভিযোগ করেন, মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিকদের উন্নয়ন চায় না।
কারণ শ্রমিকরা যদি যথাযথ ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে কাজ করে তাহলে তার কাছ থেকে সংগঠনগুলো কোন চাঁদা নিতে পারবে না।
মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি করেছে গত কয়েকদিনের ‘কর্মবিরতি’র সাথে সংগঠনের কোন সম্পর্ক নেই। শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কর্মবিরতি পালন করেছে বলে তাদের দাবি।
ইলিয়াস কাঞ্চন প্রশ্ন তোলেন, মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর নির্দেশে যদি আন্দোলন না হয়ে থাকে, তাহলে তাদের নির্দেশে আন্দোলন প্রত্যাহার হয় কিভাবে?
বুধবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সাথে বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর বৈঠকের পর কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেছে শ্রমিকরা। সে বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী নতুন সড়ক পরিবহন আইন খতিয়ে দেখার জন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হবে।
এ বিষয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আইনের কোন বিষয় নিয়ে ছাড় দেয়া ঠিক হবেনা। এবার যদি আমরা হেরে যাই, তাহলে হেরে যাবে পুরো বাংলাদেশ।
এদিকে জানতে চাইলে ট্রাক মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব তাজুল ইসলাম স্বীকার করেন যে সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন বিভিন্ন সময় টেলিভিশনে নানা মন্তব্য এবং দাবি তোলার কারণে শ্রমিকদের কেউ-কেউ তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হতে পারে।
তাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, আইন পাশ করব সরকার। উনি (ইলিয়াস কাঞ্চন) যেখানে বলে আইন পাশ করলো না কেন, আরো আইন হওয়া উচিত – এগুলো অনেক সময় শ্রমিকরা মনে হয় শোনে, সেজন্য আমার মনে হয় একটা উত্তেজনা আইসা পড়ে।
এই শ্রমিক নেতা দাবি করেন, ইলিয়াস কাঞ্চন তাদের প্রতিপক্ষ নয়। তিনি বলেন, লাখ-লাখ শ্রমিকের ভেতরে উত্তেজনা হইতেই পারে। শ্রমিকের ব্যাপারটা কন্ট্রোল করা অনেক কষ্ট।
পাঠকের মতামত