ঢাকা, Monday, 29 April, 2024

pm১৯৭১ সালের কথা বলছি। তখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তুঙ্গে।

একদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খাচ্ছে, অন্যদিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পাকিস্তানি সেনা আর তাদের এ দেশীয় দোসরদের গণহত্যা থেকে বাঁচতে কোনো রকমে প্রাণটা নিয়ে প্রতিদিন হাজারে হাজারে শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে। ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মানুষের কাছে আমাদের নাম হয়ে গেল ‘জয় বাংলার লোক’। অনেক শহরে বাসে চড়লে বা হোটেলে খেলে পয়সা নিত না। পূর্ব বাংলার মানুষের ব্র্যান্ড নাম তখন ‘জয় বাংলা’। একসময় দেশ শত্রুমুক্ত হলো। কিছুদিন পর নতুন দেশের মানুষের জন্য নতুন পাসপোর্ট তৈরি হলো। সেই পাসপোর্ট নিয়ে বাঙালি প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বিদেশে গেল। বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনরত অনেক দেশের ইমিগ্রেশন অফিসারদের কাছে নতুন দেশ বা তার নতুন পাসপোর্ট তেমন একটা পরিচিত নয়। কাউন্টারে প্রশ্নের মুখোমুখি হলে তখন বলা হতো, ‘আমরা শেখ মুজিবের দেশের লোক।

’ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন অফিসার বলতেন, ‘ও, মুজিব কান্ট্রি। ’ বলেই সিল মেরে দিতেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত অনেক দেশই বাংলাদেশকে ‘মুজিব কান্ট্রি’ নামে চিনত। শেখ মুজিব তখন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিদেশে বাঙালিদের অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ১৯৭৭ সালের মে মাসে শিকাগো শহরের এক কৃষ্ণাঙ্গ ট্যাক্সিচালক আমার কাছে জানতে চাইল আমি ভারতীয় কি না। জবাবে বলি—না, বাংলাদেশের। সঙ্গে সঙ্গে সেই ট্যাক্সিচালক বলে, ‘তোমরা তোমাদের গ্রেট লিডারকে হত্যা করেছ। ’ এককথায় আমি লাজবাব। ১৯৮০ সালেও আমি একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম প্যারিসে। বঙ্গবন্ধুর পর বাঙালিকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর পাওয়ার জন্য। অনেকে হয়তো আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাবেন, যদি বলি এই মুহূর্তে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, যিনি এখন আন্তর্জাতিক মহলে ‘মানবতার জননী’ (সড়ঃযবৎ ড়ভ যঁসধহরঃু) নামে পরিচিত। আরব আমিরাতের বহুল প্রচারিত দৈনিক খালিজ টাইমস শেখ হাসিনাকে ‘পূর্ব দেশের নতুন তারকা (ঃযব হব িংঃধৎ ড়ভ ঃযব বধংঃ) অভিধায় ভূষিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস শেখ হাসিনকে বিশ্বের ত্রিশজন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানের তালিকায় স্থান দিয়েছে। রানি এলিজাবেথ থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত যখন অর্থপাচারের দায়ে অভিযুক্ত, তখন শেখ হাসিনাকে পিপল’স অ্যান্ড পলিটিকস নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বের
তৃতীয় সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বলে রাখা ভালো, এই সব টাইটেল বা স্বীকৃতি কোনো লবি করে পাওয়া নয়। কখনো কখনো দেশ দিয়ে মানুষ পরিচিত, আবার উল্টো মানুষ বা নেতা দিয়ে দেশ পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ দেশের মানুষ অনেকটা শেখ হাসিনাকে দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই পরিচিত হচ্ছে। ‘আমি বাংলাদেশের মানুষ’ বললে উত্তর আসে, ‘ও, শেখ হাসিনা তোমাদের প্রধানমন্ত্রী। ’ দেশে ও দেশের বাইরে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কসুলভ কিছু অর্জনের কারণে তিনি এখন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর।

পেছনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহ ঘটনার রাতে ফিরে গেলে বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তাঁরা দুজন দেশের বাইরে ছিলেন বলে ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ঘটনার রাতে দুজনই বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় ছিলেন। এই রাষ্ট্রদূতকে পদায়ন না করতে বঙ্গবন্ধুকে অনেকে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো বিশ্বাস করতেন না কোনো বাঙালি তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। তিনি পরবর্তীকালে এই সব ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হয়েছিলেন। সেই রাষ্ট্রদূত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে অনেকটা জোর করে নিজ বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিলেন জার্মানিতে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ইউরোপ সফরে ছিলেন। শেখ হাসিনা তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন একটি সংবাদ সম্মেলন করার জন্য, যেখানে তিনি একা তাঁর পিতা ও পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরবেন। ড. কামাল হোসেন সংবাদ সম্মেলন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এই সব কথা বঙ্গবন্ধুকন্যা অনেকবার বলেছিলেন। মনে রাখা ভালো, ড. কামাল হোসেনের রাজনীতিতে আসা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বিদেশে শরণার্থীর জীবন যাপন করেছেন। ভারতে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন সে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তাঁর বিজ্ঞানী স্বামীর জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। শেখ হাসিনার প্রতিবেশী ছিলেন ড. কবিতা শর্মা। তাঁর স্বামী ও ভাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্য হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ড. শর্মা বর্তমানে দিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির (সার্ক বিশ্ববিদ্যালয়) প্রেসিডেন্ট (উপাচার্য)। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁদের এই নতুন প্রতিবেশী যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা তা তাঁরা অনেক পরে জেনেছেন; কারণ দিল্লিতে শেখ হাসিনা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।

১৯৮১ সালের ১৭ মে বিকেলে শেখ হাসিনা অনেকটা ছত্রভঙ্গ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দিল্লি থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেই বিকেলটা ছিল বেশ ঝোড়ো ও বৃষ্টিস্নাত। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে স্বাগত জানাতে সেদিন ঢাকার রাজপথে কয়েক লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। এমনটি দেখা গিয়েছিল শুধু পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। শেখ হাসিনাকে স্বদেশের মাটিতে স্বাগত জানাতে ঢাকায় যে জনসমুদ্র সৃষ্টি হয়েছিল, তা দেখে এটি মনে হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল যে এই দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন তাঁর রক্তের উত্তরাধিকারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করেছে। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে দেশ থেকে বিদেশ যাওয়ার সময় শেখ হাসিনার সব ছিল। ফিরলেন একাকী, বুকের ভেতর একরাশ হাহাকার নিয়ে। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে আসা লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বুঝলেন, আগামী দিনে এই নিঃস্বার্থ লাখো মানুষই হবে তাঁর পথচলার অনুপ্রেরণা। ঢাকায় তখন শেখ হাসিনার থাকার জন্য নিজের একচিলতে আশ্রয় নেই। উঠলেন ফুফুর বাসায়। স্বজন হারানোর প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে নেমে পড়লেন দল গোছানোর কাজে। সে সময় শেখ হাসিনার সুবিধা ছিল, তখন দলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত একঝাঁক নিবেদিত নেতাকর্মী ছিল, যাদের অনেকেই বর্তমানে হয় প্রয়াত বা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য যে গত তিন দশকে যারা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নৌকায় উঠেছে, তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে না, নিজের স্বার্থের বাইরে এককদমও ফেলে না, অবস্থা বেগতিক দেখলে অন্যের আশ্রয়ে চলে যেতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করবে না। একই কথা সামরিক-বেসামরিক আমলাদের বেলায়ও প্রযোজ্য, যাঁরা তাঁর শাসনামলে বেশুমার সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বে এবং দূরদর্শিতার ফলে অনেক চড়াই-উতরাই আর ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দীর্ঘ একুশ বছর পর যখন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এলো, তখন রাতারাতি ঘরে ঘরে আওয়ামী লীগ আর অঙ্গসংগঠনের জন্ম হলো, যাদের বেশির ভাগই ছিল সুযোগসন্ধানী। এদের চরিত্র হচ্ছে উইপোকার মতো। এই উইপোকাদের দাপটে প্রকৃত কর্মীরা এখন অনেকটা কোণঠাসা। এই উইপোকারা এখন বেশ সক্রিয়; এবং এই সব মোকাবেলা করেই একজন শেখ হাসিনা উজান স্রোতে নৌকা ঠেলে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে একটি নতুন পরিচয় দিয়েছেন, যাকে বলে আইডেন্টিটি।

শেখ হাসিনার তিন মেয়াদে অনেক কীর্তির মাঝে নিশ্চিতভাবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ অমর হয়ে থাকবে। পিতা বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন আর কন্যা সেই দেশের মানুষকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করেছেন। শেখ হাসিনার মেয়াদকালে দেশে উন্নয়ন হয়েছে, তা অস্বীকার করতে যেসব সুধীজন (মির্জা ফখরুল গংকে বাদ দিলাম, কারণ এটি তাদের কাজ ও পেশা) অহর্নিশ চেষ্টা চালান, তাঁরাও কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন এবং কখনো কখনো ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার চেষ্টা করেন। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে একজন বিজ্ঞ সুধীজন সেদিন একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, দেশে উন্নয়ন হয়েছে, সেই সব খবর নাকি রংপুরের ভোটারদের কাছে পৌঁছেনি, কারণ তাদের বাড়িতে নাকি টিভি নেই।

তাঁর মতে, আসন্ন নবনির্বাচনের আগে সরকারের তথা আওয়ামী লীগের উচিত সবার ঘরে ঘরে টিভি সেট পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তিনি এই সব তির্যক বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন, শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদকালে দেশে কোনো উন্নয়নই হয়নি। তিনি এও মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশে একটি সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ। কথাটা ঠিক নয়, তবে অনেক দেশের চেয়ে বেশি। তার অন্যতম কারণ একটি সড়ক নির্মাণের জন্য যে কাঁচামালের প্রয়োজন হয় তার বেশির ভাগই দেশের বাহিরে থেকে আমদানি করতে হয়। এতে ব্যয়ভার বাড়ে। আর দুর্নীতি তো আছেই। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে দুর্নীতি যে একটা বড় ধরনের সমস্যা তা মানতেই হবে। সেটি স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারের আমলেই ছিল। তবে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এটি যে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছিল, তা সেই বিদগ্ধ সুধীজন স্বীকার করবেন না। তবে তিনি সহজেই ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে দিলেন, দেশে কোনো উন্নয়ন হয়নি। আর এটাও বুঝতে হবে, শুধু উন্নয়নের কথা বলে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায় না। তা যদি হতো তাহলে সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে (প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী) সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা হেরে যেতেন না। আর দুর্নীতির প্রসঙ্গ এলে বলতে হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে অনেক দুর্নীতিবাজের বিচার হয়েছে বা বিচার চলছে।

শেখ হাসিনা বর্তমানে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন রাষ্ট্রনায়ক। ২০১৭ সালে বিখ্যাত দি ইকোনমিস্ট পত্রিকা যে চারটি দেশকে বর্ষসেরা দেশ হিসেবে ঘোষণার জন্য বিবেচনা করেছিল তার মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশও ছিল। সার্বিক বিচারে তারা দক্ষিণ কোরিয়াকে নির্বাচিত করে। ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হাতে ভয়াবহভাবে নিগৃহীত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তটি। দুই বছরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যত শরণার্থী ইউরোপে গেছে, বাংলাদেশে উনিশ দিনে ততজন আশ্রয় নিয়েছে। শেখ হাসিনা কক্সবাজারে সেই সব আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করতে গিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘আমরা যদি ষোলো কোটি মানুষকে অন্ন জোগাতে পারি তাহলে বাড়তি ছয় লাখ জনেরও অন্ন জোগাতে পারব। ’ অবশ্য বর্তমানে সেই আশ্রয় গ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় সাত লাখে ঠেকেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনা যখন এই সমস্যার কথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন তখন তিনি শুধু নিজেকে নয়, বাংলাদেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন একটি মধ্যম আয়ের দেশ। বিশ্বে ৩৩তম অর্থনীতি (পিপিপি হিসাবে)। মাথাপিছু গড় আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। গত এক দশকে গড় প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ ছিল (চলতি আর্থিক বছরে ৭.২৮ শতাংশ)। সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার। এই সব অর্জন অস্বীকার করি কিভাবে? বাংলাদেশ কোনো উন্নত দেশের ক্লাব, যেমন—জি-৭ বা জি-১০ এর সদস্য নয়। সেই ক্লাবের সদস্যরা তাদের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের ভাষায় ‘বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর উন্নয়নের’ মন্ত্র জানতে চায়। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র করেছে, যার সঙ্গে এ দেশের কিছু সুধীজনও জড়িত ছিল। সেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে বাংলাদেশের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে করতে হয় তা বাংলাদেশ থেকে শিখতে পারো। বাংলাদেশ কিভাবে জঙ্গিবাদ দমন করেছে তা-ও এখন অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে শিখতে চায়। রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করে শেখ হাসিনাই বাংলাদেশকে বিশ্বের পরমাণু ক্লাবের ৩২তম সদস্য করছেন। ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন তখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল আনুমানিক ৩ হাজার মেগাওয়াট। গত আট বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে সাড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত উৎপাদিত হয়, কারণ দেশের বিতরণব্যবস্থা এর বেশি বিতরণ করতে পারে না।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ঠিক, তবে তাঁকে ঘিরে শঙ্কাও কম নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন, তবে সেদিন তাঁর জন্য যে বুলেট বরাদ্দ ছিল তা তাঁকে এখনো তাড়া করছে। এ পর্যন্ত তিনি ১৯ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় সমাবেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যা মিশন। দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের জীবন দিয়ে শেখ হাসিনাকে সেদিন রক্ষা করেছে। সেই গ্রেনেড হামলার কুশীলবরা এখনো বাংলাদেশ, লন্ডন, পাকিস্তান, দুবাইসহ একাধিক দেশে সক্রিয়। দলের ভেতরে যেসব উইপোকা বাসা বেঁধেছে, তারা সময়মতো দলের সর্বনাশ করার জন্য সদা প্রস্তুত। সামনে জাতীয় নির্বাচন এলে তাদের অনেকের মুখোশ খুলে যাবে। গত এক বছরে যেসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছে, তারা যত না প্রতিপক্ষের কাছে হেরেছে, তার চেয়ে পরাজয়ের পেছনে নিজ দলের এই উইপোকাদের অবদান অনেক বেশি। পরাজয়ের পর প্রতিবার বলা হয়, পরাজয়ের কারণ খতিয়ে দেখা হবে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। যার ফলে আগের মতো পরাজয় আরো এক স্থানে পুনরাবৃত্তি হয়। এই সত্যটা অনেকে উপলব্ধি করে না যে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হলে তাকে পরাজিত করা এখনো কঠিন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর দলের হাল ধরে আওয়ামী লীগকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা অনাদি কাল ধরে আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি থাকবেন না। ঠিক করতে হবে তাঁর হাতের বইঠা কে তুলে নেবেন। এ ক্ষেত্রে আবেগ দিয়ে কাজ হবে না; যা হবে তা বাস্তবতার নিরিখে।

আর এক বছরের কম সময়ে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনের দল হিসেবে প্রস্তুতি শুরুর এখনই সময়। এটি মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য সময়মতো বহুমাত্রিক জোট হবে। সেখানে আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার বিরোধীরা তো থাকবেই, সঙ্গে যুক্ত হবে দেশের বেশ কিছু শক্তিশালী মিডিয়া, পরিচিত ‘নিরপেক্ষ’ সুধীজন আর অতি পরিচিত কিছু আন্তর্জাতিক শক্তি। এই সব মোকাবেলা করার দায়িত্ব এককভাবে একজন শেখ হাসিনার ওপর ছেড়ে দিলে তা হবে মহা অন্যায়। দলের নেতাকর্মীদের মনে রাখতে হবে, এই একজন শেখ হাসিনাকে ঘিরেই দেশের কোটি কোটি মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখে; কারণ তিনি তাদের একটি পরিচয় দিয়েছেন। পিতার মতো শেখ হাসিনার পদচিহ্নও এই দেশে হাজার বছর থাকুক—এই প্রত্যাশাই করি।