ঢাকা, Sunday, 5 May, 2024

soronarthiএমনিতেই রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যেই নতুন শঙ্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে আসাম। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যটি নাগরিকদের যে তালিকা করেছে, তাতে অবৈধ হতে যাচ্ছে ২০ লাখের মতো মুসলমান, যাদের বাংলাদেশী হিসেবে প্রচার করে আসছে রাজ্য সরকার। অবৈধ ঘোষিত এসব মানুষকে ফেরত পাঠানোর কথাও জোরেশোরে বলছে তারা। এমনটা হলে নতুন করে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর চাপে পড়বে বাংলাদেশ।

১৯৫১ সালের পর রাজ্যে পরিচালিত প্রথম শুমারির ওপর ভিত্তি করে নাগরিকদের খসড়া তালিকাটি তৈরি করেছে আসাম সরকার। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে পরিবার ভারতে বসবাস করত, এটা যারা প্রমাণ করতে পেরেছে, তাদেরই কেবল নাগরিক হিসেবে বৈধতা দেয়া হয়েছে। তালিকায় নাম না থাকা বাসিন্দারা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য হবে। এরপর দেশ ছাড়তে হবে তাদের। গতকাল মধ্যরাতে খসড়া তালিকাটি প্রকাশ করার কথা।

বাংলাদেশের জন্য বিষয়টিকে উদ্বেগজনক মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দিল্লিতে বিশেষ প্রতিনিধি পাঠিয়ে হলেও ভারত সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির এ বিষয়ে বলেন, আসাম সরকার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর সেখানে যাওয়া মানুষকে বের করে দেয়ার কথা বলছে। বলা হচ্ছে, যাদের তারা সন্দেহ করছে, তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৭১ কেন কাট-আপ পয়েন্ট হিসেবে ধরা হলো? সাতচল্লিশ নয় কেন? ১৯২৪ নয় কেন? তখনো তো বিপুলসংখ্যক মানুষ একদিক থেকে অন্যদিকে মাইগ্রেট করেছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্ট করার লক্ষ্যে এটা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে কিছু করা যাবে না। কিন্তু তেমন কোনো ঘোষণা এলেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। দিল্লিতে বিশেষ প্রতিনিধি পাঠিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে বিষয়টি বুঝতে হবে। দিল্লিতে আমাদের রাষ্ট্রদূত অথবা কলকাতা, গৌহাটিতে নিযুক্ত উপরাষ্ট্রদূত বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

আসামের বিষয়ে বাংলাদেশের পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, প্রত্যাবাসনের একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রথমে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি বাংলাদেশকে জানাতে হবে। এরপর পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিতে হবে। বাংলাদেশ ওই তালিকা যাচাই-বাছাই করে দেখবে। এরপর যাদের বাংলাদেশের নাগরিক বলে শনাক্ত করা হবে, তাদের ধাপে ধাপে ফিরিয়ে আনা হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে বিদেশে অবৈধভাবে থাকা সব বাংলাদেশীকে ফিরিয়ে আনা।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নাগরিকত্ব প্রমাণের যে শর্ত দেয়া হয়েছে, অনেকেই তার স্বপক্ষে দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারেননি। সংখ্যাটি ২০ লাখের মতো। দেশ ছাড়ার আতঙ্কে আছে এদের প্রত্যেকেই। এ ধরনের শঙ্কার মধ্যে গত এক মাসে গোয়ালপাড়া, সোনিতপুর ও শিলচর জেলায় ডজনখানেক মানুষ আত্মহত্যাও করেছে।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাজ্যটিতে বসবাস করে আসা কাছাড় জেলার বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এখানে বসবাস করছি। কিন্তু এখন নিজেকে ভারতীয় প্রমাণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমাদের পরিবারের সদস্য চারজন। প্রমাণ জোগাড় করতে আমরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দৌড়েছি। তবে আমার বাবা নিরক্ষর শ্রমিক ছিলেন। তিনি এ ধরনের কোনো কাগজ সংরক্ষণ করেননি।

স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও সম্পদ সংরক্ষণের জন্য অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়ন বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একটি। তারই অংশ হিসেবে নাগরিকদের এ তালিকা তৈরি। রাজ্যের মুসলিম নেতাদের অভিযোগ, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট নিশ্চিতে বিজেপি মুসলিমদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

এমনটা হলে বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী বলেন, বিষয়টি এখনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তারাও বিষয়টি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত নয়। ফলে আসামের অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফেরত নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

এদিকে নাগরিকদের নতুন তালিকা নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কা করছে আসাম সরকারও। এ আশঙ্কা থেকে রাজ্যের নিরাপত্তাও জোরদার করেছে তারা। কেন্দ্রীয় প্যারামিলিটারি বাহিনীর প্রায় ৬০ হাজার সদস্যকে আসামের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এরই মধ্যে মোতায়েন করা হয়েছে।

এ অবস্থায় আসাম সীমান্তে নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবি সিলেট সেক্টরের ৪১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আবুজার আল জাহিদ বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি সম্পর্কে আমরা এখন পর্যন্ত অবগত নই। তবে সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বিজিবি সবসময়ই প্রস্তুত আছে। সীমান্ত দিয়ে চাইলেই কাউকে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এজন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আলোচনার মাধ্যমে এগোতে হবে।

উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার পর নতুন করে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করেছে আগে থেকেই। সব মিলিয়ে এখন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বইতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

সূত্র: বণিক বার্তা