শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক এমএ সাঈদের ছেলে ফুটপাতের চা বিক্রেতা

imageরাজশাহীর শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক এমএ সাঈদ। দেশের জন্য জীবন দিলেও স্বাধীন দেশে ভালো নেই এই শহীদের পরিবারটি। তার সন্তানদের কেউ ফুটপাতে চা বিক্রি করেন, কেউ পরিবহন শ্রমিক, কেউ পত্রিকার হকার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি পরিচিত নাম ছিলো এমএ সাঈদ। তাঁর জন্ম নরসিংদী জেলায়। ১৯৪৯ সালে কৃষি বিভাগে চাকরি নিয়ে তিনি রাজশাহী আসেন। শহীদ হবার পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাজশাহীতেই স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে তাঁর কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলেন। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তাদের চতুর্থ পর্যায়ের প্রকাশনায় শহীদ এমএ সাঈদসহ ১৬ জনের নামে দুই টাকা মূল্যের ‘শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মারক ডাকটিকিট’ বের করে।

রাজশাহীতে তিনি ছিলেন ‘দৈনিক আজাদ’ ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক লোকসেবক’ এর নিজস্ব সংবাদদাতা। পরবর্তীকালে তিনি ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘ডেইলি অবজারভার’, ‘পয়গাম’, ‘জেহাদ’ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গের সংযুক্ত ছিলেন।

সাংবাদিক হিসেবে সংবাদপত্রের পাঠক সৃষ্টি করার প্রতিও শহীদ এমএ সাঈদের ছিল তী² মনোযোগ। এই দায়িত্ব তিনি পালন করতেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে। সাধারণ মানুষ যাতে খবরের কাগজ পড়তে উৎসাহী হন সেজন্য তিনি নিজে সাইকেলে করে তৃণমূল পর্যন্ত সংবাদপত্র পৌঁছে দিতেন।

রাজশাহীতে প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এমএ সাঈদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫৪ সালের আগে রাজশাহীতে কোন প্রেসক্লাব ছিল না। শহীদ এমএ সাঈদ একটা ছোট্ট লন্ড্রি ও তার সঙ্গে সংযুক্ত চায়ের দোকানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। শহীদ এমএ সাঈদ শুধু সাংবাদিকই ছিলেন না, একজন ভাল নাট্যসংগঠক, নাট্যশিল্পী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন।

রাজশাহীর প্রবীন সাংবাদিক আহমদ সফি উদ্দিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে অসহযোগ আন্দোলনের সময় রাজশাহীতে ‘শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এর আহবায়ক ছিলেন সাংবাদিক এমএ সাঈদ। এই পরিষদ ২৫ মার্চ রাতে ভূবনমোহনপার্কে মঞ্চস্থ করে মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘রক্তের রঙ লাল’। এই নাটকের শেষ অংশের সংলাপে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। নাটক শেষ হবার সাথে সাথে পাকিস্তানী আর্মিরা এসে ভূবনমোহন পার্ক ঘিরে ফেলেছিলো। এটাই হয়তো কাল হয়েছিলো এমএ সাঈদের জন্য।

তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে রাজশাহীর একজন প্রভাবশালী সাংবাদিক ছিলেন এমএ সাঈদ। ওই সময় গ্রেটাররোডে শুধু মাত্র দৈনিক আজাদ পত্রিকার রাজশাহীতে একটি ব্যুরো অফিস ছিলো। ওই অফিসের ব্যুরো প্রধান ছিলেন এমএ সাঈদ। আর সংগ্রাম পত্রিকায় ছিলেন আলামিন নামের একজন সাংবাদিক। পাকিস্তানের পক্ষে দালালি করতেন। খুব সম্ভবত আলামিনের মাধ্যমেই পাকিস্তানীরা তথ্য নিয়ে সাংবাদিক এমএ সাঈদকে আটক করে হত্যা করেছিলো।’ তিনি আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সন্তানরা সবাই ছোট ছিলো। তাই পড়ালেখা শিখতে পারেনি। চাকরিও পায়নি। সরকারকে এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো উচিত।’

১৯৭১ সালের ২৮ জুন সামরিক বাহিনীর লোকেরা এমএ সাঈদকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। শহীদ এমএ সাঈদ পাকিস্তানী জল্লাদদের হাতে কবে মৃত্যুবরণ করেন তা সঠিক ভাবে জানা যায়নি। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের বন্দী দশা থেকে ফিরে আসা একজনের কাছ থেকে জানা যায়, রেললাইনের কাছাকাছি বন্দীদের গুলি করে হত্যা করার পর গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয়। সেই বন্দীদের মধ্যে এমএ সাঈদও ছিলেন।

সাংবাদিক এমএ সাঈদ এর দ্বিতীয় ছেলে এসএম আলমগীর (বাবলু) এখন শিরোইল বাস টার্মিনালের সামনের ফুটপাতে চা বিক্রি করেন। আগে চালাতেন রিকসা।

বাবার স্মৃতিচারণ করে বাবলু বলেন, ‘আব্বা কৃষি বিভাগে চাকরি করতেন। সাংবাদিকতা করতেন। নাটক করতেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর ভুবন মোহন পার্কে স্বাধীনতার পক্ষে যেসব মিছিল সমাবেশ হতো সেখানেও উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিতেন। ওই মিছিলে জাতীয় নেতা কামারুজ্জামান হেনাসহ অনেকেই থাকতেন। তারা আমাদের বাসাতেও আসতেন। মায়ের গরুর মাংস রান্না খুব পছন্দ করতেন। ওনাদের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো।’

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ চতুর্থ পর্যায়ের প্রকাশনায় শহীদ এমএ সাঈদসহ ১৬ জনের নামে দুই টাকা মূল্যের ‘শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মারক ডাকটিকিট’ বের করে।

বাবলু জানান, মুক্তিযুুদ্ধ শুরু হবার পর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তখন ষষ্ঠীতলা এলাকার একটি বাড়িতে ছিলাম আমরা। ওই সময় খান সেনাদের একটি বড় গাড়ী আসলো। খান সেনারা আমাকে উর্দুতে বললো, ‘এই লাড়কা সাঈদ রিপোর্র্টার ক্যা মাকান কিধার হ্যায়?’ তখন আমি অন্য একটি বাসা (ইউনিক টেইলারের মালিকের বাসা) দেখিয়ে দিলাম। গাড়ী ওই দিকে চলে গেলো । গিয়ে সামনে পড়লো এক পিস কমিটির সদস্যা। উপহার সিনেমা হলের সামনে তার বাড়ি। নাম কাইয়ুম। উনাকে আবারো জিঙ্গেস করলো, ‘সাঈদ রিপোর্টার ক্যা মাকান কিধার হ্যায়?’ তখন আমি ভয়ে মসজিদের পাশে লুকিয়ে গেলাম। মসজিদের পাশ থেকে লুকিয়ে দেখছি। আটজন খান সেনা বাড়ি ঢুকে। আমার চোখের সামনেই আব্বাকে গাড়ীতে করে নিয়ে যায়। তারপর বাড়িতে এসে দেখলাম ছোট মা কাঁদছেন।

মায়ের কাছে জানলাম, খান সেনারা এসে মেজর পারভেজ ডেকেছেন বলে সার্কিট হাউসে নিয়ে গেছেন। খান সেনারা বাড়ি এসে ভুবন মোহন পার্কের আব্বার মিছিলের ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কার ছবি ?’ তখন আব্বা বললেন, ‘এটা আমার ছবি।’ তখন খান সেনারা বললেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে আপনারা কেন এসব করছেন? মেজর পারভেজ আপনাকে ডেকেছেন। সার্কিট হাউসে যেতে হবে।’

এরপর বাবার সহযোগি স্টার স্টুডিওর মালিক মোতাহার হোসেন, ঘড়ি ঘরের মালিক নাসির আহমেদ আমার বাবাকে খুঁজতে বের হলেন। বিভিন্ন জায়গায় খুজলেন। কোথাও পেলেন না। কিছুদিন পর শাহমখদুম ইন্সটিটিউটের পিয়ন কাদের মিয়া এসে আমাদের জানালেন, ‘সাঈদ ভাইকে আর খুঁজবেন না। উনাকেসহ ১৩ জনকে জোহা হলে খান সেনারা গুলি করে। সেখানে আমিও ছিলাম। গুলি লাগার আগেই আমি মাটিতে পড়ে যাই। মরার ভান করেছিলাম। খান সেনারা ভেবেছে আমিও মরে গেছি। তারপর সবাইকে গর্তে ফেলে দেয়। তারপর খান সেনারা চলে গেলে আমি লাশ ভর্তি গর্ত থেকে পালিয়ে আসি।’ এরপর থেকে আমরা জেনেছি বাবা আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের বধ্যভূমিতে। সেখানকার বধ্যভূমিতে শহীদদের নামের তালিকায় আমার বাবার নামও রয়েছে।’

শহীদ সাংবাদিক এমএ সাঈদের সন্তানদের মধ্যে এসএম আলমগীর (বাবলু) এখন বড়ই অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছেন। চার ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে তিনি চরম অভাব অনটনে বাস করছেন। বাবলু আগে রিকসা চালাতেন। পরে শিরোইল বাস টার্মিনালের সামনের ফুটপাতে চা বিক্রি করেন। মাঝে মাঝেই ফুটপাত উচ্ছেদ হয়। তখন বাবলু বেকার হয়ে পড়েন।

বাবলু বলেন, ‘শহীদ সাংবাদিকের ছেলে হলেও আমার বা আমাদের কোন ভাই বোনের নিজস্ব ঘর বাড়ি নেই। মালদা কলোনিতে দুটি রুম ভাড়া নিয়ে বসবাস করি। শহীদ কামারুজ্জামানের সহচর হিসেবে আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন। এখন আমাদের কেউ চেনেন না। টাকার অভাবে সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। তারাও এখন আমার সঙ্গে ফুটপাতে চা বিক্রি করে। তাদের চাকরি দরকার। কিন্তু কে দেবে?’

শুধু বাবলু একা নন, তার মতই অসহায় দিনযাপন করছেন তার অন্য ভাইয়েরা। বড় ভাই বুলবুল অসুস্থ অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় বিছানায় পড়ে আছেন। বাবলুর ছোট ভাই মৃনাল পত্রিকার হকারি করে সংসার চালান। আরেক ভাই সেন্টু পরিবহন শ্রমিক। বোনের জামাই ডেইজির স্বামী ইসরাইল রিকসা চালান। সাত ভাই সাত বোনের মধ্যে কিছুটা ভালো আছেন রেলের কর্মচারি পিন্টু, মিন্টু ও আজাদ।

এমএ সাঈদের মেয়ে জামাই নাট্যব্যক্তিত্ব মনোয়ার হোসেন মনো জানান, স্বাধীনতার পর প্রথম ৪০ বছর এই পরিবারের সদস্যরা কিছুই পায়নি। ৪০ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেও শহীদের স্বীকৃতি পাননি। তিনি সরকার স্বীকৃত শহীদ বুদ্ধিজীবি হলেও শহীদ হিসেবে ভাতা পাননা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে সামান্য ভাতা পান তা ১৪ জনের মধ্যে ভাগাভাগি করে তাদের কিছুই হয়না। তিনি জানান, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার আবেদনে কিছুটা ভুল থাকায় এসমস্যা হয়েছে। পরে আর সমাধান হয়নি।

মনোয়ার হোসেন মনো আরো জানান, দেশ স্বাধীনের সময় এমএ সাঈদ ছিলেন তৎকালিন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। রাজশাহীতে আর্ট কাউন্সিল বর্তমানে পদ্মা মঞ্চ ও রাজশাহী প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন ছিলেন। বাংলাদেশ বেতার, রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতাকালিন সময়ে বাংলা খবর পাঠক ও অভিনেতা ছিলেন। তিনি শহীদ হবার পর বঙ্গবন্ধু তার পরিবারকে সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং একটি সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। পরে সার্টিফিকেটটি হারিয়ে যায়।

এই শহীদের সন্তানদের কারোই রাজশাহীতে একটু জায়গা নেই। সবাই ভাড়া বাড়িতে, ফুটপাতের ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করেন। অভাব অনটন আর বিনা চিকিৎসায় তাই দুজন স্ত্রী মারা গেছেন। এখন সন্তানরাও অভাব অনটনে ভূগছেন। সরকার আর কবে এই শহীদ পরিবারটিকে সহযোগিতা করবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *